আপনি কি বিশ্বজিত ভাই কে নিয়ে চিন্তিত? কিংবা দুঃখিত? কিংবা হতাশ? অথবা আপনি কি এই মুহুর্তে নিজেকে নিয়ে চিন্তিত? ... এই তো ঠিক লাইনে আসছেন! আপনি আমি কেন বিশ্বজিতকে নিয়ে চিন্তিত হব? সে একজন সাধারন, অতি তুচ্ছ মানুষ। মৃত্যুর পরে সে নিউজের লিড জায়গা পেয়েছে, বিএনপি কর্মী খেতাব পেয়েছে, ছাত্রলীগ কর্তৃক কোপ খাওয়া বিশেষন পেয়েছে ... আর কি চাই একটা মানুষের জীবনে? মরুক সে, আমার কি?
আমি বরং কিছুটা চিন্তিত আমাকে নিজেকে নিয়ে, কবে যেন আমাকে শিকে ঝুলায়ে আগুনে পোড়ায়। আচ্ছা, আপনি কি ওই বাসের নিচে পিষ্ঠ হওয়া পিকেটার কথা ভাবছিলেন কখনো? মানে, জীবনের একেবারে শেষ মিনিটে ওর মাথায় কি ছিল? ঠিক যখন ওর মাথাটা থেতলে যাচ্ছিল, তখন কি ও একটিবারের জন্য ভাবছিল ও কেন মারা যাচ্ছে? ও কি ওর বাসায় বৃদ্ধ বাবা কিংবা মায়ের কথা ভাবছিল? ছোট আদরের বোন কিংবা সদ্য বিবাহিত লাল টুকটুকে বউটার কথা একটি বারের জন্যও ভাবছিল? নাকি ভাবছিল সেই নেতাটির কথা যে ওকে বাসে আগুন দিতে বলেছিল?
মজার কথাটা কি জানেন? আজকে যদি ওই বাসটি ওকে না পিষে থামাত, তাহলে আমার আরো অনেক গুলো মানুষকে নিয়ে(যারা ওই বাসে ছিল)লিখতে হত হয়ত। পেপারওয়ালাদের আরো কিছু কাগজ বেশী খরচ করতে হত বাসের ভিতরে পুড়ে যাওয়ার মানুষগুলোর জন্য রিপোর্ট বাবদ। সে যাকগে, আসল কথায় আসি! আপনি কি আজকে মারা যাওয়া চার জন এর কাউকে নিয়ে মনের ভিতরে দুঃখ পেয়েছেন? আপনি নিশ্চিত থাকুন, আপনি কেন, আমি নিজেও দুঃখ পাইনি। এইযে যা লিখছি সব সস্তা পাবলিসিটি। মানুষ পড়বে, লাইক দিবে, বেশি ভাল লাগলে শেয়ার দিবে, কমেন্ট করবে। খুব করে বলবে, "বাহ! ছেলেটা লেখে জব্বর!"
এগুলো যখন ঘটছিল আমি কিন্তু তখন চিন্তা করছিলাম অ্যাসাইনমেন্টটি নিয়ে যেটা সাবমিট করলে আমার রেজাল্ট ভাল হবে, আমি ভবিষ্যতে বেশী বেশী ইনকাম করব। কিংবা আমি ভাবছিলাম কিভাবে ঘুমায়ে ঘুমায়ে দিনটাকে ইনজয় করা যায়, অথবা মিস করছিলাম ইউনির আড্ডা গুলোকে। মাঝে মাঝে অবশ্য আমার ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিতে ইচ্ছা করছিল যে, "ধুর কাজের সময়ে হরতাল দিতে পারে না! আকাইম্মা টাইমে ঠিকই হরতাল দিছে।" মানে কিন্তু খুব সোজা, আমার মাথায় বিশ্বজিতরা নেই। থাকবে কেন? ও তো আমার দাদা না। ও তো দেশের সেরা ক্রিকেটার না যে ওর কবে বিয়ে হবে সেটা নিয়ে খুব এক্সাইটেড হয়ে আমি নিউজের পাতা উল্টাবো। সব থেকে বড় কথা, ওকে নিয়ে ভাবতে হবেই বা কেন? আমার দেশে কি মানুষ কম আছে? এরকম দুই একটা আমজনতা চলে গেলে আমার কি? এরকম ঘটনা কি একেবারেই নতুন?
ঘটনা কিন্তু আজকে একদিনে হয়নি। এরকম আরো অনেক বিশ্বজিতরা রাস্তায় মার খেয়েছে। হয় এদলের, নয় ওদলের। গনতন্ত্রের দোষ কোথায় জানেন? অন্য সকল তন্ত্রের দোষগুলি ধরতে গিয়ে কখন যে নিজের তন্ত্রটিই হারিয়ে ফেলে, নিজেও জানে না সেটি। এই আমরাই কিন্তু নেতাদের নির্বাচিত করি, এইদফা এই নেতা, পরেরবার ওই নেতা। আমাদের চয়েজ কিন্তু খুব সোজা, এ নয়ত সে!
আমরা আসলে মনে হয় আশ্চর্য হওয়ার ক্ষমতাটাই হারিয়ে ফেলেছি। আসলেই হারিয়ে ফেলেছি। এই যে দিনের আলোতে টিভি ক্যামেরার সামনে বিশ্বজিত ভাই কোপ খেলো, কেন জানেন? নেতারা অ্যাকশান চায়, মৃত বডি চায়! আমরা নেতার পোষা কুকুর হয়ে গিয়েছি। আমরা আমাদের নিয়তি মেনে নিয়েছি। আমরা কুকুরের থেকেও অধম হয়ে গিয়েছি। আমরা হায়না পশু হয়ে গিয়েছি। এ তো গেল নেতাদের গল্প, আমাদের গল্প কি জানেন? আমরা যেইটা করব, চ্যানেল ঘুরায়ে ঘুরায়ে এই একি ঘটনা দেখব। নানা অ্যাঙ্গেলে কোপ গুলা অ্যানালাইসিস করব। খুব আফসোস করব, এর পরেই রাতের ডিনারটা সেরে ফেলব পরিবারের সাথে। এরপর ফেসবুকে বসব স্ট্যাটাস দেওয়ার জন্য। আমাদেরই বা কি দোষ বলুন, আমাদের এর থেকে করারই তো নাই কিছু। যদি কিছু করার থাকে তো আমাদের বাপ কিংবা মামাদের আছে। মানে, আমাদের যাদের বাপের পয়সা আছে তারা বিদেশে চলে যাব, আর যাদের বাপের পয়সা নাই কিন্তু হালকার উপর "মামা" আছে তারা সরকারী চাকুরি নিয়ে দেশটাকে চুষে খাব। এরপরে যারা বাকি থাকবে, তারাই না হবে বিশ্বজিত? আমরা নাকি বঙ্গ'মাতার সন্তান! জয় বঙ্গমাতা!